
বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত: এক অগ্নিপুরুষের জীবনকথা
উল্লাসকর দত্ত, ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যাঁর জীবন ত্যাগ, সাহস ও দেশপ্রেমের এক অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত। তিনি অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্টের (বর্তমান সিলেট, বাংলাদেশ) কালীকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনকাহিনী একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরে, তেমনই অন্যদিকে বিপ্লবীদের অদম্য স্পৃহার পরিচয় বহন করে।
উল্লাসকর দত্তের বিপ্লবী জীবনের সূচনা ছাত্রাবস্থাতেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে এক ইংরেজ অধ্যাপক রাসেলের বাঙালি বিদ্বেষী মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানানোর জন্য তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং সম্ভবত তাঁকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আরও দৃঢ় অবস্থান নিতে উৎসাহিত করে। এরপর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন, যা প্রমাণ করে তাঁর মেধা ও জ্ঞানের গভীরতা।
Ullaskar Dutta in Bengali
বিপ্লবী বিপিন চন্দ্র পালের আদর্শ ও অনুপ্রেরণায় উল্লাসকর দত্ত বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেন। এই সময় থেকেই তিনি ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিধান শুরু করেন, যা ছিল তাঁর দেশপ্রেম ও স্বাদেশিকতার প্রতীক। স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হন এবং যুগান্তর দলের মতো বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করেন।
উল্লাসকর দত্ত শুধু একজন বিপ্লবী কর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। বোমা তৈরিতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। তাঁর তৈরি করা ফর্মুলা অনুসরণ করেই বিপ্লবীরা বোমা তৈরি করতেন। এমনই একটি বোমা পরীক্ষার সময় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে দেওঘরের কাছে নির্জন দীঘারিয়া পাহাড়ে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। বোমা বিস্ফোরণে বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী মারা যান এবং উল্লাসকর দত্ত গুরুতরভাবে আহত হন। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে ডাক্তার ও বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক অত্যন্ত গোপনে তাঁর চিকিৎসা করেন এবং তাঁর জীবন বাঁচান।
Biography of freedom fighter Ullashkar dutta in Bengali
উল্লাসকরের ফর্মুলা অনুযায়ী তৈরি বোমা ক্ষুদিরাম বসুকে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণের জন্য দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২রা মে মুরারিপুকুর বাগানবাড়িতে পুলিশ হানা দেয় এবং উল্লাসকর দত্তসহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনা ‘আলিপুর বোমা মামলা‘ নামে পরিচিত। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এই মামলায় উল্লাসকর দত্তকে প্রথমে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, পরে তা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয় এবং তাঁকে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।
সেলুলার জেলের অমানবিক নির্যাতন উল্লাসকর দত্তের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের ফলে তিনি সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন, কিন্তু তাঁর বিপ্লবী চেতনা তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে এবং ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেয়।
বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত র জীবনকাহিনি
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর ভারত স্বাধীন হলে উল্লাসকর দত্ত তাঁর নিজের গ্রাম কালীকচ্ছ ফিরে যান। জেল জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন—’দ্বীপান্তরের কথা‘ এবং ‘আমার জীবন‘। এই গ্রন্থগুলি তাঁর জীবনের কঠিন সময়ের জীবন্ত দলিল।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে উল্লাসকর দত্ত ব্যক্তিগত জীবনেও পরিবর্তন আনেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৬৩ বছর বয়সে তিনি বিপিনচন্দ্র পালের বিধবা কন্যাকে বিয়ে করেন। এরপর ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং জীবনের শেষ দিনগুলো শিলচরে কাটান। সেখানেই ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে এই মহান বিপ্লবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উল্লাসকর দত্তের জীবন এক অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী। তিনি শুধু একজন বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী, লেখক এবং সর্বোপরি একজন দেশপ্রেমিক, যিনি দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর ত্যাগ ও অবদান ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
F.A.Q
Q.1: উল্লাসকর দত্ত কে ছিলেন?
Ans: উল্লাসকর দত্ত ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহান বিপ্লবী, বিজ্ঞানী ও লেখক।
Q.2: উল্লাসকর দত্ত কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
Ans: তিনি বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট জেলার কালীকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Q.3: কীভাবে তাঁর বিপ্লবী জীবনের শুরু হয়?
Ans: প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়নকালে এক ইংরেজ অধ্যাপকের বাঙালি বিদ্বেষী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় তাঁকে বহিষ্কার করা হয়, যা তাঁকে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করে।
Q.4: উল্লাসকর দত্ত কোন বিপ্লবী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন?
Ans: তিনি যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন এবং স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
Q.5: উল্লাসকর দত্তের বিশেষ দক্ষতা কী ছিল?
Ans: তিনি বোমা তৈরির বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং তাঁর তৈরি ফর্মুলা অনুসারে বিপ্লবীরা বোমা প্রস্তুত করতেন।
Q.6: কোন ঘটনার কারণে তিনি গ্রেপ্তার হন?
Ans: ১৯০৮ সালে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ‘আলিপুর বোমা মামলায়’ গ্রেপ্তার হন।
Q.7: তাঁর শাস্তি কী হয়েছিল?
Ans: প্রথমে তাঁকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়, পরে তা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হয় এবং তাঁকে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।
Q.8: সেলুলার জেলে তাঁর কী অবস্থা হয়েছিল?
Ans: অমানবিক নির্যাতনের কারণে তিনি কিছু সময়ের জন্য মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
Q.9: তিনি কখন মুক্তি পান?
Ans: ১৯২০ সালে তিনি মুক্তি পান এবং কলকাতায় ফিরে আসেন।
Q.10: উল্লাসকর দত্ত কোন গ্রন্থ রচনা করেন?
Ans:তিনি ‘দ্বীপান্তরের কথা’ ও ‘আমার জীবন’ নামে দুটি গ্রন্থ লিখেছেন, যেখানে তাঁর কারাগারের অভিজ্ঞতা বিবৃত হয়েছে।
Q.11: তিনি কাকে বিয়ে করেন?
Ans: ১৯৪৮ সালে তিনি বিপিনচন্দ্র পালের বিধবা কন্যাকে বিয়ে করেন।
Q.12: উল্লাসকর দত্তের মৃত্যু কবে ও কোথায় হয়?
Ans: তিনি ১৭ মে ১৯৬৫ সালে শিলচরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
Q.13: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লাসকর দত্তর অবদান কী?
Ans: তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, বোমা তৈরির মাধ্যমে বিপ্লবীদের সহায়তা করেন এবং বহু বছর কারাবরণ করেন, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আরো দেখো :-
মাধ্যমিক 2025 | ইতিহাস ম্যাপ পয়েন্টিং
আরোও দেখো :-
Madhyamik Physical Science Suggestion 2025 – আয়নীয় ও সমযোজী বন্ধন (অধ্যায়-৮.২) প্রশ্নউত্তর – মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞান সাজেশন
আরোও দেখো :-
দশম শ্রেণী ভৌত বিজ্ঞান | পর্যায় সারণী – প্রশ্ন উত্তর সাজেশন | WBBSE Class 10th Physical Science Suggestion
আরোও দেখো :-
Madhyamik Physical Science Question Paper 2024 With Answers | সম্পূর্ণ উত্তরসহ মাধ্যমিক ভৌত বিজ্ঞান প্রশ্নপত্র ২০২৪
আরোও দেখো:-
Madhyamik Physical Science Suggestion- পরিবেশের জন্য ভাবনা (অধ্যায়-১) প্রশ্ন-উত্তর – মাধ্যমিক ভৌতবিজ্ঞান সাজেশন
- চরকসংহিতা: প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের অমূল্য রত্নপ্রাচীন ভারতে চিকিৎসাশাস্ত্রের যেসকল কীর্তি আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত, তার মধ্যে অন্যতম হল চরক রচিত ‘চরকসংহিতা‘। এই মহাগ্রন্থটি শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার পাশাপাশি, এটি বহু চিকিৎসককে অনুপ্রাণিত করেছে এবং তাদের পথপ্রদর্শন করেছে। চরকের পরিচয় চরকসংহিতার রচয়িতা চরক সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন ভারতের …
- ভারতের জাতীয় দিবসভারতের জাতীয় দিবস গুলি হল সেই বিশেষ দিনগুলি, যা ভারতীয় ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং যা গোটা দেশ জুড়ে পালিত হয়। এই দিনগুলি ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং জাতীয় চেতনাকে প্রতিফলিত করে। প্রধান জাতীয় দিবসগুলি হল: ১. স্বাধীনতা দিবস (১৫ আগস্ট): ১৯৪৭ সালের এই দিনে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এই দিনটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের …
- জীবক: প্রাচীন ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্রপ্রাচীন ভারতে চিকিৎসাশাস্ত্রে জীবক ছিলেন এক কিংবদন্তী বিজ্ঞানী। তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ এবং তাঁর অবদান আজও স্মরণীয়। জীবকের জীবন ও শিক্ষা মগধের রাজা বিম্বিসার একদিন রাতে প্রজাদের অবস্থা জানতে বের হয়েছিলেন এবং রাস্তায় একটি নবজাতকের কান্না শুনতে পান। তিনি শিশুটিকে উদ্ধার করে নিজের পুত্র হিসেবে লালন-পালন করেন এবং তক্ষশীলা শিক্ষানিকেতনে পাঠান। সেখানে জীব-ক গুরু আত্রেয়ের …
- প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার জন্য পরিবেশ বিদ্যা প্রশ্নউত্তরবিভিন্ন প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় পরিবেশ সংক্রান্ত যে সমস্ত প্রশ্ন করা হয়, সেই সব প্রশ্ন ও তাদের উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সফল হতে গেলে পরিবেশ থেকে ভাল করে প্রশ্ন উত্তর প্র্যাক্টিস করতে হবে। পরিবেশ বিদ্যা প্রশ্নউত্তর এর বাস্তুবিদ্যা এবং বাস্তুতন্ত্র (Ecology and Ecosystem) Environmental studies in bengali ১. প্রশ্ন: ” …
- বরাহমিহির: জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতিষী ও পণ্ডিতবরাহমিহির ছিলেন উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক উজ্জ্বল রত্ন। জ্যোতিষশাস্ত্র, অঙ্কশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর মতো পারদর্শী কেউ ছিলেন না। উজ্জয়িনীর নবরত্ন মিহিরের জন্ম ও পরিচয় কিংবদন্তী অনুসারে, তাঁর পিতার নাম ছিল বরাহ এবং পুত্রের নাম ছিল মিহির। প্রথমে বরাহ নবরত্ন সভায় স্থান পান, পরে বিক্রমাদিত্য মিহিরকে সভায় নিয়ে আসেন। সম্রাটের ইচ্ছা ছিল খণাকেও সভায় …
- সীতারাম রাজু |Who was Alluri Sitaram Raju Class 10ঘন জঙ্গল, ব্রিটিশ অত্যাচার, আর এক অদম্য বিদ্রোহী! আল্লুরি সীতারাম রাজু, এক নাম যা আজও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। আদিবাসীদের হৃদয়পুরুষ, রম্পা বিদ্রোহের নেতা, যিনি অহিংসা থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জানুন, কীভাবে এক সাধারণ মানুষ হয়ে উঠলেন অরণ্যের অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা। তার জীবনকাহিনী আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে আল্লুরি সীতারাম রাজু: অরণ্যের বীর অন্ধকার রাত, …