উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কেন বিখ্যাত ? Upendranath Brahmachari in Bengali

Upendranath Bramhachari
Upendranath Bramhachari

প্রাচীনকালে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে মানুষের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল খুব কম। কারণ তখন এত রকমের ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। কুসংস্কার এবং দেবদেবীর উপর নির্ভর করেই মানুষ জীবন নির্বাহ করত। সেই সময় কিছু মানুষ এই দুরারোগ্য ব্যাধি গুলোকে দূর করার জন্য ও তাদের নিরাময়ের জন্য নিরন্তর চেষ্টা শুরু করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড: উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর জন্ম ও বংশ পরিচয়:

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ১৮৭৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ড: নীলমণি ব্রহ্মচারী। তিনিও পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক।

শিক্ষা:

ছোটবেলা থেকেই উপেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রতিভাধর ছাত্র। স্থানীয় স্কুল এর পাঠ শেষ করে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। 1893 সালে হুগলি কলেজ থেকে অংকে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করেন। এখানেও তিনি দারুন রেজাল্ট করেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন।

শুধুমাত্র গণিত নয় পরবর্তীকালে চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং রসায়নবিদ্যা এই দুটি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৮৯৫ সালে রসায়ন শাস্ত্রে এমএসসি পাস করেন। এরপর মেডিসিন এবং সার্জারিতে প্রথম স্থান অধিকার করে পাস করেন ডাক্তারি।

ডাক্তারি পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমডি করেন। এরপর গবেষণার কাজে যুক্ত হন এবং ১৯০৪ সালে পিএইচডি কমপ্লিট করেন। রক্তের গঠন নিয়ে নানারকম গবেষণা তিনি করেন।

কর্মজীবন: Upendranath Brahmachari in Bengali

কর্ম কর্মজীবনের প্রথমে তিনি ঢাকা মেডিকেল স্কুলে অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন সময়টা ছিল ১৯০৫ সাল অর্থাৎ সেই সময় বঙ্গভঙ্গ নিয়ে মেতে রয়েছে দেশ। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলে মেডিসিন অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। কলকাতায় এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শুরু হয় তার গবেষণা যার মধ্যে রয়েছে রসায়নবিদ্যা, জীববিদ্যা।

সেই সময় কলেরা, বসন্ত, টাইফয়েড, কালা জ্বর, যক্ষা এই সবগুলো রোগ ই ছিল দুরারোগ্য। অর্থাৎ চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। প্রথম জীবনে উপেন্দ্রনাথ ম্যালেরিয়া রোগ এবং তার ওষুধ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন সেই সময় বাংলাদেশ তথা সারা ভারতবর্ষে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল খুব বেশি। 

1897 সালে বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করেন। ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কারের পর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এই বিষয়ে গবেষণায় আকৃষ্ট হন এবং বেশ কিছুদিন তিনি এই নিয়ে গবেষণাও করেছিলেন।। এই ক্ষেত্রে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। 

কালা জ্বরের ঔষুধ আবিষ্কার

এখনকার মানুষ কালা জ্বরের কথা হয়তো শোনেনি। কারণ এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছিলেন ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী।

কোন একজন ইংরেজ ডাক্তার বাবু কালাজ্বরের মৃত রোগীদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। যে এই রোগটা কোন জীবাণু ঘটিত তা জানার জন্য। তিনিই একদিন কালা জোরে মৃত রোগীর প্লীহা নিয়ে গবেষণা করছিলেন হঠাৎ তার নজরে আসে প্লিহার মধ্যে রয়েছে অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবাণু। তিনি এই জীবাণুগুলোর নাম দেন এল ডি বডি

এরপর অনেক বিজ্ঞানী কালাজ্বরের জীবাণু নিয়ে গবেষণা এবং তার প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। ১৯০৪ সালে রজার নামে এক বিজ্ঞানী তিনি বলেন কালাজ্বরের মূলে আছে এক ধরনের মাছি। এই মাছি রোগীর শরীর থেকে জীবাণু বহন করে অন্য শরীরে নিয়ে যায়। মাছিটি কামড়ানোর পর থেকে 3-4 মাস পর এই রোগের লক্ষণ দেখা যায়।

কালা জ্বরের রোগ লক্ষণ

কালা জ্বরের লক্ষণ হল প্রথমে অল্প জ্বর হয় এবং প্লীহা ও যকৃতের বৃদ্ধি ঘটে। এর সাথে সাথে শরীরে রক্তের পরিমাণ কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে রোগীর শরীর কালো হয়ে যায়। লিস্ ম্যান এবং রজার্স নামে এই দুই বিজ্ঞানী কালাজ্বর নিয়ে অনেক গবেষণা করলেও তারা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেননি।।

১৯২২ সালে স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী আবিষ্কার করলেন কালাজ্বর এর প্রতিষেধক ইউরিয়া ষ্টিবামিন।

বিজ্ঞান চর্চায় উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর অবদান

রসায়নবিদ্যায় মৌলিক গবেষণার জন্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন উপেন্দ্রনাথ। তার গবেষণা গুলি দেশ-বিদেশের বহু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। জীববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা নিয়ে তার মোট গবেষণা পত্রের সংখ্যা শতাধিক।

তবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ইউরিয়া স্টিবামীন। গবেষণা পত্রে তিনি উল্লেখ করেছিলেন কালা জ্বরের জীবাণু রোগীর শরীরের বিভিন্ন অংশে থাকতে পারে এমনকি চামড়ার নিচেও থাকতে পারে।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতোই তিনিও দেশীয় কারখানা গড়ার দিকে মন দেন। এর জন্য ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে একটি দেশীয় ঔষধ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। শুধু বিজ্ঞান নয় দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কে বাড়িয়ে তোলার দিকেও তিনি মননিবেশ করেন।

তিনি ভারতীয় মিউজিয়াম এবং রেডক্রসের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য তার ছিল একটি প্রিয় বিষয়। সারা জীবনে যা অর্থ উপার্জন করেছেন তার অনেকাংশই ব্যয় হয়েছে দানে। 

পুরস্কার:

ছাত্রজীবনে এবং কর্মজীবনে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়ার জন্য তিনি যেমন একাধিক স্বর্ণপদক লাভ করেন। তেমনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রিফিত পুরস্কার, কলকাতা স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন থেকে মিন্টো পদক এবং এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্যার উইলিয়াম জোনস পদক লাভ করেন।

কালা জ্বরের ঔষধ ইউরিয়া স্তিবামিন আবিষ্কারের পর তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় দেশ-বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান সভা তাকে শ্রদ্ধা এবং সম্মান জানিয়ে ছিল।

রয়েল সোসাইটি অফ মেডিসিন তার গবেষণাকে কুর্নিশ জানিয়ে ছিল তার সাথে পরবর্তীকালে এই সংস্থার সাথেও তিনি যুক্ত হন। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধি প্রদান করেন। ১৯৩৬ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে মূল সভাপতিত্ব করেন। তার রচিত অন্যতম বইটির নাম হল ‘ট্রিটইস অন কালাজ্বর’

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর মৃত্যু:

১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি এই মহান বিজ্ঞানী ও ডাক্তারের দেহা বসানো হয়। যে সমস্ত ভারতীয় বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের গবেষণায় মানুষ কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন তাদের মধ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী


Leave a Comment