ভারতীয় রসায়নের জনক: আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় | Acharya Prafulla Chandra Roy discovered Mercurous Nitrite

Acharya Prafulla Chandra Roy in bengali
Acharya Prafulla Chandra Roy

যে সমস্ত ভারতীয় বিজ্ঞানী দেশীয় বিজ্ঞান চর্চায় মননিবেশ এবং উন্নতির নিরলস প্রচেষ্টা করে গেছেন। তাদের মধ্যে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় অন্যতম। সহজ সরল এবং সাদাসিধে একজন বৈজ্ঞানিক। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস ’।

বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি সমাজের উন্নতির জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ নিয়ে গেছেন। আজীবন চেষ্টা করেছেন দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য। কর্ম বিমুখ বাঙালিকে তিনি ব্যবসা করার নানা উপায়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন

“ দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্ট টিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না।”

………আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

Table of Contents

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট বাংলাদেশের খুলনা জেলার রাতুলি কাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামটি ছিল কপোতাক্ষ নদীর ধারে এবং অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভরপুর। এই নদীর ধারেই আরো একটি গ্রাম সাগরদাঁড়ি সেখানে জন্মেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পিতা ছিলেন হরিশচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন তখনকার দিনের জমিদার এবং মহা পন্ডিত ব্যক্তি। ইংরেজি সংস্কৃত ফরাসি ইত্যাদি সাহিত্যে তিনি বুৎপত্তি লাভ করেন। কবিতা প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনায় তিনি সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। গ্রামের মধ্যে একটি বড় লাইব্রেরী স্থাপন করেন। তার পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার পিতার মতই পড়াশোনায় মগ্ন থাকতেন।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী

শিক্ষা

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল গ্রামেরই এক ছোট স্কুলে ।এই স্কুলটি তারি পিতার প্রতিষ্ঠিত। গ্রামের বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে তারা সপরিবারে কলকাতায় চলে আসেন পরবর্তী পড়াশোনার জন্য। কলকাতা এসে পিতা হরিশচন্দ্র রায় তার পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করেন।

সেই সময় প্রফুল্ল চন্দ্রের বয়স মাত্র ১০ বছর। সারাদিনই মগ্ন থাকতেন পড়াশোনা নিয়ে। তার ধ্যান জ্ঞানী ছিল জ্ঞানার্জন। এত পড়াশোনার কারণে পিতার বকুনিও সহ্য করতে হয়েছে তাকে।

হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি মেট্রোপলিটন কলেজে ভর্তি হন। সেখানকার পড়াশুনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যাত্রা করেন। প্রথমে আর্থিক অবস্থার জন্য সাময়িক অসুবিধার মধ্যে পড়েন।

তারপরেই বিএ পরীক্ষার সময় তিনি গিলক্রিস্ট ব বৃত্তি লাভ করেন। বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিএসসি পাস করেন।

পি.জি.টেট এবং এসি. ব্রাউন এর শিক্ষার্থী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি জৈব রসায়নের দিকে আকৃষ্ট হন।

কর্মজীবন

স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ২৭ বছর অধ্যাপনা করেন। অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য ক্রমেই তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে স্বনামধন্য অধ্যাপক হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ক্লাসে তার পড়ানোর ভাষা ছিল বাংলা।

“কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাইস্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়”

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

তার ছাত্ররা তাকে শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়ে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করতেন। বিজ্ঞান সাধনায় তার কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে সি.আই.ই উপাধি প্রদান করে। পরে তিনি নাইট উপাধিও পান।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আবিষ্কার

প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রসায়নবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তার বিখ্যাত আবিস্কারটি হল মারকিউরাস নাইট্রাইট। পারদ এবং লঘু নাইট্রিক এসিডের বিক্রিয়ায় হলুদ রঙের এই মারকিউরাস নাইট্রাইট নামক পদার্থটি উৎপন্ন হয়। বাংলায় একে রস সিঁদুর ও বলা হয়ে থাকে।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের ছাত্র

ভারতবর্ষের অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্রের ছাত্র। তার কাছে গবেষণা করে অনেকেই বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী হয়েছিলেন

মেঘনাথ সাহা সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, পুলিনবিহারী সরকার এরা ছিলেন তার বিখ্যাত সব ছাত্র।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের স্বদেশপ্রেম

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের দেশের প্রতি প্রেম সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চিন্তায় তিনি সর্বদাই মগ্ন থাকতেন। ছাত্র-ছাত্রী মহলে তিনি বলতেন বিজ্ঞান সাধনার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর জীবন যাত্রার মানের উন্নতি হবে।

ব্রিটিশরা বলত প্রফুল্ল চন্দ্র বিজ্ঞানী ছদ্মবেশে একজন বিপ্লবী তিনি নাকি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের অস্ত্রকেনার টাকা যোগাতেন।

তিনি গান্ধীজীর নীতি অনুসরণ করে অবসর সময় চরকা দিয়ে সুতো কাটতেন। তিনি তার সর্বস্ব দিয়ে দেশের দরিদ্র জনগণের সেবা করে গেছেন। বিজ্ঞান কলেজের পাঠদান কালে তিনি যে বেতন পেতেন তার অধিকাংশ দান করে দিতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নতির জন্য।

১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়ঙ্কর বন্যা হয় সেই বন্যার জন্য তিনি তার সর্বস্ব দান করে দিয়েছিলেন এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কে দান করেছিলেন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমরা দুজনে সহযাত্রী, কালের তরীতে আমরা প্রায় একঘাটে এসে পৌছেছি।’ সেদিন রবীন্দ্রনাথ তুলে দিয়েছিলেন একটি তাম্রফলক, তাতে খোদাই করা ছিল কবির লেখা দুটি লাইন -‘প্রেম রসায়নে ওগো সর্বজনপ্রিয়, করিলে বিশ্বের জনে আপন আত্মীয়।’

বেঙ্গল কেমিক্যাল এর প্রতিষ্ঠা

বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি তার স্বপ্ন ছিল এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেখানে দেশবাসীরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। তার সাথে বিদেশি পণ্য ত্যাগ করে স্বদেশী পণ্যের দিকে মানুষ আকৃষ্ট হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যাল নামক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন যেটি আজও সুনামের সাথে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে চলেছে। যেমন ন্যাপথালিন ফিনাইল ও নানারকমের ঔষধ। এই বেঙ্গল কেমিক্যাল এ বহু কর্মসংস্থান হয়।

প্রফুল্ল চন্দ্রের জাতীয়তাবাদ ও বিজ্ঞান চেতনা

স্বদেশের জন্য তার জাতীয়তাবাদ একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী থেকে কোনভাবেই কম ছিল না। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চা যে কত উন্নত ছিল তা বারবার তিনি ভারত বিরোধী মানুষদের বুঝিয়েছিলেন এবং বিজ্ঞান চর্চার পথ সুগম করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের লেখা বই

প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন পুঁথি থেকে একটি অসাধারন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বইটির নাম দিয়েছিলেন “হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি” এই বইতে তিনি লিখে গেছেন প্রাচীন ভারত বিজ্ঞান চর্চায় কতটা উন্নত ছিল।

“…যেসব জন্ম-সাহিত্যিক গোলমালের মধ্যে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে, জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাদের ফের জাতে তুলব। আমার এক একবার সন্দেহ হয় আপনিও বা সেই দলের একজন হবেন “

প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সমাজ সংস্কারক রূপে প্রফুল্লচন্দ্র

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাল্যবিবাহ জাতিভেদ ইত্যাদি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা গুলিকে ঘৃণা করতেন। কুসংস্কার দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করতেন।  অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদে সামিল হতেন। স্পষ্ট কথা স্পষ্টভাবে বলতেই তিনি পছন্দ করতেন।

তিনি দেশের মানুষকে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জাগরিত করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি বলতেন অনুষ্ঠান মঞ্চে বড় বড় বক্তৃতা না দিয়ে নিজ দরিদ্র মানুষের সেবা এবং জাতিভেদ প্রথা কে দূরে সরিয়ে রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের মহান ব্রত। দেশমাতার সেবাই আমাদের পরম ধর্ম।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মহাপ্রয়াণ

১৯৪৪ সালের ১৬ই জুন ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীর আকাশ থেকে একটি নক্ষত্রের পতন হয়। সেই নক্ষত্র আর কেউ নয় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র। তার সহজ সাধারণ জীবনযাত্রা এবং অমূল্য বাণী ভারতবাসীর পাথেয় হয়ে রয়েছে।

🅵🅰🆀

Q.1: আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কে?

Ans: আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন বাঙালী বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ।

Q.2: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের শিক্ষাগত পাঠক্রম কেমন ছিল?

Ans: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের পড়াশোনা গ্রামের স্কুল থেকে শুরু হয়েছিল এবং তার শিক্ষাগত কর্মজীবনে মেট্রোপলিটন কলেজ এবং ইংল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থান করে।

Q.3: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কর্মজীবনে কী অংশ ছিল?

Ans: তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন এবং পরবর্তীতে বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন।

Q.4: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বিজ্ঞান সাধনা ও জাতীয়তাবাদের কী ভূমিকা ছিল?

Ans: প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিজ্ঞান সাধনার পাশাপাশি সামাজিক জনসচেতনার উন্নতির জন্য জোর দেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ এবং বিজ্ঞান চেতনার গুরুত্ব স্বীকার করতেন।

Q.5: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম স্থান ও তার কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল?

Ans: প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৬১ সালে খুলনার রাতুলি কাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করা।

Leave a Comment