মেঘনাদ সাহা: খ্যাতনামা বাঙালি বিজ্ঞানী | থার্মাল আয়োনাইজেশন তত্ত্ব

জন্ম ও বংশ পরিচয়

বাংলাদেশের অন্তর্গত ঢাকা জেলার শেওড়াতলি গ্রামে মেঘনাথ সাহা র জন্ম হয় 1893 সালের 6 অক্টোবর। তার পিতার নাম জগন্নাথ সাহা এবং মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে বড় হয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি পিতার মুদিখানার দোকানে কাজও করতেন।

মেঘনাদ সাহার শিক্ষাজীবন

Meghnad Saha
Meghnad Saha

 নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঢাকা জেলা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করে মিডিল স্কুল বাস করেন। ১৯০৫ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন মাসে ১২ টাকা বৃদ্ধি লাভ করে। ১৯০৯ সালে পূর্ববঙ্গের সব ছাত্রের মধ্যে প্রথম হয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। এখানেও তিনি সফল হন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।

এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় আসেন আর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তারি সাথে ভর্তি হন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিজ্ঞানীরা।

এরপর গণিত শাস্ত্রে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার ডিগ্রী তে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার অধ্যক্ষ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ স্নেহধন্য তিনি ছিলেন।

গবেষণা ও কর্মজীবনে কৃতিত্ব

মেঘনাদ সাহা পদার্থবিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কারের আত্মনিয়োগ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি উপাধি প্রাপ্ত হন ১৯১৮ সালে পান প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি। এছাড়াও তিনি গুরু প্রসন্ন ঘোষ ফেলসিপ লাভ করেছিলেন। ১৯১৯ সালে তিনি ইউরোপ যাত্রা করেন।

১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অফ দি ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এ মেঘনাদ সাহার মহাকাশ বিজ্ঞান সংক্রান্ত একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রটি সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে আলোড়নের সৃষ্টি করে এছাড়াও বিখ্যাত সাইন্স পত্রিকা নেচার এ তার একটি লেখা প্রকাশিত হয় যেটিও বিজ্ঞানী মহলে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে।

১৯২০ সালে লন্ডনের ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে মেঘনাদ সাহা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহা কলকাতায় ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান। বিজ্ঞানী সাহার স্বপ্ন ছিল একটি উন্নত মানের গবেষণাগার তৈরি করা। তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান এবং সর্বময় কর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

এর পাশাপাশি নতুন বিজ্ঞানীদের নিয়ে গবেষণার কাজও চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে ইন্ডিয়ান সাইন্স কংগ্রেস এসোসিয়েশনের একটি অধিবেশনে সর্বস্তরের বিজ্ঞানীরা যোগদান করেছিলেন এবং এই সভায় মেঘনাদ সাহা ভারতের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস সম্পর্কে একটি সুচিন্তিত ভাষণ প্রদান করেছিলেন। ১৯৩০ সালে এলাহাবাদ বিজ্ঞান পরিষদ স্থাপন করেন এবং ১৯৩৪ সালে বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি পদ অলংকৃত করেছিলেন।

সমাজের উন্নতিতে অংশগ্রহণ

মেঘনাদ সাহা চেয়েছিলেন তার গবেষণালব্ধ ফলগুলি সাধারণ মানুষের কাজে লাগুক এটাই তার সব থেকে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে মত্ত থাকলেও সমাজের উন্নতির দিকে তার সজাগ দৃষ্টি ছিল ও তার জন্য তার নানা পরিকল্পনা ছিল। তিনি যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তেমনি ছিলেন একজন সমাজ সেবকও।

১৯১৪ সালে বন্যা ত্রাণে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে বেঙ্গল রিলিফ কমিটিতে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সাথে একসাথে কাজ করেন। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ভারতবর্ষে আগত উদ্বাস্তুদের দুঃখ দুর্দশা দেখে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিরোধী প্রার্থী হয়ে লোকসভায় প্রবেশ করেন। আমৃত্যু তিনি বিরোধী পক্ষের অন্যতম নেতা হিসেবেই রয়ে গিয়েছিলেন।

মেঘনাদ সাহার গবেষণা

মেঘনাদ সাহার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণ। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন পৃথিবীতে থাকা সব জিনিসই সূর্যের মধ্যেও আছে। তিনি হিসাব করে দেখিয়েছিলেন সূর্যের প্রতি ১০০ ভাগের মধ্যে হাইড্রোজেন আছে একাশি ভাগ বাকি ১৮ ভাগ হিলিয়াম,সিলিকন,সিসা,লোহা, দস্তা, অক্সিজেন ইত্যাদি। তিনি আরো প্রমাণ করেছিলেন কেবল সূর্য নয় যে কোন নক্ষত্র পৃষ্ঠেই মৌলিক পদার্থগুলো গ্যাসীয় অবস্থায় অবস্থান করে।

সূর্যরশ্মির এই বিশ্লেষণের সাহায্যে মহাবিশ্বের অন্যতম রহস্য নক্ষত্র গুলি কি দিয়ে তৈরি, তা তিনি উন্মোচন করেন। বলা হয় নিউটনের আবিষ্কারের পর মেঘনাদ সাহার এই আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার

মেঘনাদ সাহার বিদেশ যাত্রা

তিনি বিদেশের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি তে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, বস্টন একাডেমি অফ সায়েন্স এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ফ্রান্সের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি এবং বোস্টন একাডেমি অফ সায়েন্স এর তিনি ফেলো নির্বাচিত হন। ইতালি সরকারের আমন্ত্রণে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন ভোল্টার জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে।

১৯৪৭ সালে লন্ডন থেকে আমন্ত্রিত হয়ে বিকেলে নিউটনের ৩০০ তম জন্মবার্ষিকীতে অংশগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে রাশিয়া ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে “রাশিয়া আমার অভিজ্ঞতা” নামক একটি বই লেখেন। ভারত সরকারের বৈজ্ঞানিক শুভেচ্ছা কমিশনের সদস্য রূপে আমেরিকা গিয়েছিলেন।

মেঘনাদ সাহা রচিত পুস্তক

তিনি বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ সরল ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। তার লেখা বই “দি প্রিন্সিপাল অফ রিলেটিভিটি” এবং “ট্রিটিস অফ হিট” নামক উচ্চশিক্ষার্থীদের জন্য খুবই উপকারী।

মেঘনাদ সাহা ও স্বদেশী আন্দোলন

ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঘাযতীন, পুলিন দাশ প্রমুখ বিপ্লবীর সাথে তার যোগাযোগ ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী থাকার জন্য ছাত্র জীবনে তিনি একটি পরীক্ষা, ফিন্যান্স পরীক্ষা দিতে পারেননি।

বিজ্ঞানের অগ্রগতিতেমেঘনাদ সাহার কৃতিত্ব

বিশ্ব বিখ্যাত শিক্ষক ও গবেষক মেঘনাদ সাহা দেশীয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির অন্যতম একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতায় ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সাইক্লো ট্রন যন্ত্র স্থাপন করেন।

ভারতীয় শিল্পের প্রসারে তিনি উদ্যোগী হন এবং জহরলাল নেহেরুকে জাতীয় পরিকল্পনার কথা জানান। সায়েন্স অ্যান্ড কালচার নামক একটি পত্রিকা তিনি প্রকাশ করেছিলেন সেই পত্রিকায় তদানীন্তন ভারতবর্ষের নানা রকম সমস্যা সম্পর্কে একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেন। তার মধ্যে ছিল দামোদর উপত্যকার সংস্কার উড়িষ্যার উন্নয়ন খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ ভারতের জাতীয় গবেষণা নদী উপত্যকার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় প্রবন্ধ।

তার প্রতিষ্ঠিত সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স সংক্ষেপে এস আই এন পি দেশীয় বিজ্ঞান গবেষণায় এক অন্যতম পথিকৃৎ এখান থেকে বহু স্বনামধন্য বিজ্ঞানী বিদেশের বড় বড় গবেষণাগারে কাজ করে চলেছেন

মেঘনাদ সাহার মহাপ্রয়াণ

এই মহান বিজ্ঞানী বহু প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে জীবনে এগিয়ে গেছেন। দারিদ্রতা তাকে আটকে রাখতে পারিনি এই অসাধারণ বিজ্ঞানের প্রতিভা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল 1956 সালের 16 ফেব্রুয়ারি। আজও তিনি ভারতীয় বিজ্ঞানী মহলে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে রয়েছেন।

Leave a Comment