আবুল কাশেম ফজলুল হক: বাংলার এক কিংবদন্তী

Abul Kasem Fazlul Huq
Abul Kasem Fazlul Huq

আবুল কাশেম ফজলুল হক, যিনি ‘শের-ই-বাংলা‘ বা ‘হক সাহেব‘ নামেও সুপরিচিত, ছিলেন ঔপনিবেশিক বাংলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন ছিল কর্মবহুল, বৈচিত্র্যময় এবং একই সাথে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের এক প্রতিচ্ছবি। শুধু রাজনীতি নয়, শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন।

ফজলুল হকের শিক্ষাজীবন ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও তাঁর আগ্রহ ছিল ব্যাপক। কর্মজীবনে তিনি আইন ব্যবসা, অধ্যাপনা, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাব-ডিভিশনাল অফিসারের মতো বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এই বহুমুখী অভিজ্ঞতা তাঁকে সমাজের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে গভীর ধারণা দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

রাজনীতিতে হাতেখড়ি:

বরিশালের প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা অশ্বিনীকুমার দত্তের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফজলুল হক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। ১৯১২ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন, এবং এর মাত্র এক বছর পরেই, ১৯১৩ সালে, ৩৯ বছর বয়সে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি শিক্ষার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন।

একক পথে বহু যাত্রা:

ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন ছিল বহু ধারায় প্রবাহিত। একদিকে তিনি ১৯১৪ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৯১৮ সালে এই দলের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। অন্যদিকে মুসলিম লীগের সাথেও তাঁর সম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর কংগ্রেস কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটিরও তিনি একজন সদস্য ছিলেন।

খিলাফত ও অসহযোগ:

খিলাফত আন্দোলনের সময় তিনি খিলাফত কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে, মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্জনের ফলে তাদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। এই সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে।

শিক্ষা ও স্বরাজ:

১৯২৪ সালে খুলনা থেকে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ লাভ করেন। তবে চিত্তরঞ্জন দাশ মতিলাল নেহরুর স্বরাজ্য দলের প্রভাবে তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন।

কৃষক-প্রজা ও হক-লীগ সরকার:

১৯২৯ সালে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফজলুল হক বাংলার কৃষকদের সংগঠিত করার প্রয়াস নেন। এই সমিতি পরবর্তীতে কৃষক-প্রজা পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। এই দলের নেতৃত্বে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এই দল জয়লাভ করে মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করে বাংলায় হক-লীগ সরকার গঠন করে এবং ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। এই সরকারের সময়ে তিনি বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ এবং কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন।

শ্যামা-হক সরকার ও দেশভাগ:

হক-লীগ সরকারের পতনের পর, ১৯৪১ সালে তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভার সাথে কোয়ালিশন করে শ্যামা-হক সরকার গঠন করেন। তবে, স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়তে থাকলে ফজলুল হকও এর প্রভাব থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে পারেননি। ১৯৩০-৩১ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে তিনি মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান। এক সময়ের ২১ জন সদস্যের কৃষক-প্রজা পার্টি ত্যাগ করার ঘটনাকে তিনি ‘ইসলামের স্বার্থ-বিরোধী‘ বলে মন্তব্য করেন। এমনকি ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে তিনিই পৃথক পাকিস্তানের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তাঁর দল পরাজিত হওয়ার পর তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

উপসংহার:

আবুল কাশেম ফজলুল হকের জীবন ছিল বহু ঘাত-প্রতিঘাতে পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক এবং বাংলার মানুষের মুক্তির দিশারী। তাঁর কর্ম ও আদর্শ আজও বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা যোগায়।

FAQ

Q.1: আবুল কাশেম ফজলুল হক কে ছিলেন?

Ans: আবুল কাশেম ফজলুল হক, যিনি ‘শের-ই-বাংলা’ বা ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত, ঔপনিবেশিক বাংলার একজন উজ্জ্বল রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবক ছিলেন।

Q.2: ফজলুল হকের শিক্ষাজীবন কেমন ছিল?

Ans: তাঁর শিক্ষাজীবন অত্যন্ত উজ্জ্বল ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও তিনি বেশ আগ্রহী ছিলেন।

Q.3: ফজলুল হক কর্মজীবনে কী কী পেশায় যুক্ত ছিলেন?

Ans: তিনি আইন ব্যবসা, অধ্যাপনা, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সাব-ডিভিশনাল অফিসারের মতো বিভিন্ন পেশায় কাজ করেছেন।

Q.4: মুসলিম লীগে ফজলুল হকের ভূমিকা কী ছিল?

Ans: তিনি ১৯১২ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন এবং ১৯১৩ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া, তিনি ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন।

Q.5: ফজলুল হক কোন ঐতিহাসিক চুক্তিতে ভূমিকা রাখেন?

Ans: ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐতিহাসিক লক্ষ্ণৌ চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

Q.6: ফজলুল হক কংগ্রেস ত্যাগ করেন কেন?

Ans: খিলাফত আন্দোলনের সময় কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের কারণে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

Q.7: কৃষক-প্রজা পার্টি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

Ans: ১৯২৯ সালে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফজলুল হক বাংলার কৃষকদের সংগঠিত করেন, যা পরবর্তীতে কৃষক-প্রজা পার্টিতে রূপান্তরিত হয়।

Q.8: ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন কখন?

Ans: ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করার পর মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন করে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন

Q.9: শ্যামা-হক সরকার কী?

Ans: হক-লীগ সরকারের পতনের পর, ১৯৪১ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু মহাসভার সাথে কোয়ালিশন করে শ্যামা-হক সরকার গঠন করা হয়।

Q.10: ফজলুল হকের জীবনের প্রধান অবদান কী?

Ans: শিক্ষা বিস্তার, জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ এবং কৃষকদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি বাংলার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

Leave a Comment